নার্সিসিজম – সরল আত্মপ্রেম নাকি মানসিক রোগ?

বর্তমান সময়ের ব্যাপক প্রচলিত শব্দগুলোর একটি হলো “নার্সিসিজম”। শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক পুরাণের চরিত্র নার্সিসাসের নাম থেকে, যে কিনা নিজ রূপে মুগ্ধ হয়ে আত্মাহুতি দিয়েছিলো। মূলত মানুষের মনের সুপ্ত বা জাগরিত প্রবল আত্মপ্রেম বা আত্মকেন্দ্রিকতাকেই সংক্ষেপে নার্সিসিজম হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। কোনো কোনো মনোবিদের মতে এটি মানব স্বভাবের একটি অংশ হলেও মাত্রাতিরিক্ত নার্সিসিজম জন্ম দেয় নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার নামক মানসিক রোগের। এমনকি অনেক নার্সিসিস্ট কালক্রমে সাইকোপ্যাথও হয়ে যায়।

বেশকিছু রিসার্চ মোটাদাগে নার্সিসিজমকে দুইভাগে ভাগ করেছে। এর একটি Adaptive Narcissism বা অভিযোজনমূলক নার্সিসিজম, অন্যটি Maladaptive Narcissism বা অনভিযোজনমূলক নার্সিসিজম।

অভিযোজনমূলক নার্সিসিজমের বৈশিষ্ট্য হলোঃ

  • আত্মসম্মানবোধ
  • নিজের দোষগুণ সম্পর্কে সচেতনতা এবং নিজেকে শুধরে নেয়ার প্রবণতা
  • অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
  • নতুন কিছু শেখার আগ্রহ এবং তার মাধ্যমে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টাঅর্থাৎ ব্যক্তিত্বের পরিমিতিবোধের সাথে সম্পর্কিত বৈশিষ্ট্যই অভিযোজনমূলক নার্সিসিজমের অন্তর্ভুক্ত।

অন্যদিকে অনভিযোজনমূলক নার্সিসিজমের বৈশিষ্ট্য হলোঃ

  • প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা
  • তোষামোদের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষা
  • নিজের প্রতি বিশ্বাস কম থাকা এবং তা আগ্রাসী মনোভাব দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা
  • নিজের দোষত্রুটি সম্পর্কে তীব্র উদাসীনতা এবং সকল বিষয়েই ভিত্তিহীনভাবে নিজেকে সঠিক ভাবা।
  • অন্যকে মানসিক বা শারীরিকভাবে আঘাত করে কিংবা কোনো ভুল উপায় অবলম্বন করে হলেও নিজের জন্য প্রশংসা আদায় করা এবং কারো প্রতি সহানুভূতিশীলতা না থাকা।
  • কোনোরূপ সহনশীলতা না থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সহনশীল এবং সহানুভূতিশীল দাবী করা।
  • কাজের বদলে বাগাড়ম্বরপূর্ণভাবে নিজেকে জাহির করে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা।এই ধরণের নার্সিসিজমকেই মনোবিদরা নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার নামক রোগে আখ্যায়িত করেছেন। এরা কখনোই নিজেকে শুধরে নিতে চায়না। যা সময়ের সাথে ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তি সাইকোপ্যাথেও পরিণত হতে পারে।

নার্সিসিজম দুইভাবে একজন মানুষের ভেতর জায়গা করে নিতে পারে। জিনগত উপায়ে নয়ত শৈশবকালীন বিভিন্ন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। একজন ব্যক্তির বেড়ে ওঠাকালীন বিভিন্ন ঘটনা তার মধ্যে জন্ম দেয় স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গি, যা কখনো কখনো ব্যক্তিকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। আবার ব্যক্তির স্বভাবের অন্তর্মুখিতা বা বহির্মুখিতা অনুসারেও নানারকমের নার্সিসিজম দেখা দিতে পারে। যেমন কোনো অন্তর্মুখী ব্যক্তির প্রবল রক্ষণশীলতা, অতিরিক্ত পরিমানে একা থাকা, যেকোনো বিষয়ে অতিরিক্ত লজ্জা বা হতাশা, যেকোনো কাজে নিজের প্রতি প্রবল অবিশ্বাস ইত্যাদিও এক প্রকার নার্সিসিজম। যাকে বলা হয় Covert Narcissism. আবার এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের নার্সিসিজমকে বলা হয় Overt Narcissism যার প্রকাশ ঘটে তীব্র অহংকার, অন্যকে ছোট করে হলেও নিজেকে বড় প্রমান করতে চাওয়া, নিজের ভুল স্বীকারে অনাগ্রহ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে।

তবে কারো ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বা মানসিক রোগ যে হিসেবেই নার্সিসিজম আমাদের কাছে ধরা পড়ুক না কেন, তা যেন কখনোই আমাদের নিজেদের মানসিক অবস্থাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে না পারে সে ব্যাপারে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি কোনো নার্সিসিস্ট ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক বা কাজের ক্ষেত্রে অবলম্বন করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিক এবং কৌশলগত উপায়। প্রয়োজনে নেয়া যেতে পারে পেশাদার মনোবিদের পরামর্শ। সেইসাথে মনে রাখতে হবে সকল নার্সিসিস্টই মানসিক রোগী না।

– Maruf Al Berunee


Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.