পড়ি কিন্তু আসলে পড়ি কী?

সেদিন একজন বিদগ্ধ মুরব্বি যিনি দ্বীনের জ্ঞান রাখেন তিনি বলছিলেন, “আফসোস যে তথাকথিত মুসলিম যাদের বিশ্বাসের কিতাব শুরু হয়েছে “ইক্বরা” বা পড়ার নির্দেশের মাধ্যমে তারাই পড়ার নামে আদৌ পড়ে না, বরং তারা “না পড়াটাকেই” সিস্টেমেটিক, ধর্মীয় (!) রীতি ও প্র্যাক্টিসে রূপদান করেছে।” যখন জানতে চাওয়া হলো, অনুগ্রহ করে ব্যাখ্যা করুন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলছিলেন:

একটা উদাহরন দিলে হয়তো ১৫০০ বছরের যে ব্রেনওয়াশিং আর ইন্টেলেকচুয়াল মরিচা তাকে অতিক্রম করে বুঝতে কিছুটা সুবিধা হবে। আমরা অনেকে হয়তো জানি যে, ল্যাটিন হরফ ব্যবহার করে পৃথিবীতে অনেকগুলো ভাষা লেখা হয়। যেমন জার্মান, ইতালিয়ান বা হাঙ্গেরিয়ান। ধরেন আমি আপনাকে একটা ইতালিয়ান ভাষার পত্রিকা, ‘লা স্টামপা’ বের করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই পত্রিকার হেডলাইনটা পড়ে বলেন ইতালিতে আজকের প্রধান খবর কি?

আপনি বললেন: ভাই আমি তো ইতালিয়ান পারি না। আমি বললাম আপনি ইংরেজী অক্ষর নিশ্চই চিনেন। ইতালিয়ান ভাষা ঐ একই ইংরেজী (বা ল্যাটিন) হরফ ব্যবহার করে লেখা হয়।সুতরাং আপনি অবশ্যই চেষ্টা করেন, দেখেন পড়তে পারবেন।

আজ ১২ই নভেম্বর লা স্টামপা পত্রিকার হেডলাইন:

Volano gli stracci in casa centrodestra. Berlusconi: “Siamo alla dittatura”. Salvini: “Sciocchezze da frustrati di sinistra”

আপনি সামান্য একটু অনভ্যস্তার কারনে কষ্ট করে পড়লেন, আমি শুনে যাচ্ছি: “ভোলানো গ্লি স্ট্রাচ্চি ইন কাসা সেনট্রোডেস্ট্রা. বারলুসকুনি সিয়ামো আলা দিটটাটুরা। সালভিনি সিওচেজজে ডা ফ্রাসত্রাতি ডি সিনিসট্রা।”

আমি বললাম ইতালির সহী ও শুদ্ধ উচ্চারনে অনেক অক্ষরই বাংলার মতো কোমল। যেমন ডি না, দি। ডা না, দা। টি অক্ষরটাকে ওরা ত এর মতো নরম করে বলে। দিটটাটুরা না, ওটা হবে দিততাতুরা।

আপনি সহী ও শুদ্ধ পদ্ধতিতে আবার পড়লেন: “ভোলানো গ্লি স্ট্রাচ্চি ইন কাসা সেনত্রাদিস্তা. বারলুসকুনি সিয়ামো আলা দিততাতুরা। সালভিনি সিওচেজজে দা ফ্রাসত্রাতি দি সিনিসট্রা।”

– পারফেক্ট। এখন বলেন কি পড়লেন ভাই? হেড লাইনের বিষয়টা কি তাইলে?

আপনি চোখ বড় বড় করে আমাকে উত্তর দিলেন: ‘অর্থ তো বুঝি না। অক্ষর দেখে শুধু উচ্চারন করলাম মাত্র!’

– তো এটাকে কি পড়া বলা উচিত?

– পুরোপুরি না

– কেন?

– কারন আমি কেবল অক্ষরগুলোর ধ্বনি বা শব্দরূপ উচ্চারন করেছি, অর্থ বুঝি নাই

– একদম ঠিক। এটা খুব কমন সেন্সের ব্যাপার। পড়া মানে শুধু অক্ষর চিনে উচ্চারন করাই নয়, Comprehension বা বুঝতে হয়। স্কুলে আমরা বাচ্চাদের কমপ্রিহেনশন শিখাই যেন সে একটা শব্দের, একটা প্যারাগ্রাফের মেক সেন্স করতে পারে। আমি অক্ষর চিনে চিনে নিচের খবরটা পড়ে (!) ফেলতে পারবো যদি আমি ইংরেজী A B C D চিনি:

Elezioni di guerra nel Sud-Est ucraino. I separatisti filorussi sfidano Kiev chiamando alle urne gli abitanti delle zone sotto il loro controllo. L’obiettivo dichiarato è eleggere i presidenti e i deputati delle repubbliche autoproclamate di Donetsk e di Lugansk. Ma in realtà molti ritengono le elezioni di ieri un escamotage per dare una legittimità di facciata a coloro che il Cremlino ha già posto al vertice delle gerarchie ribelli. Non per niente, mentre Ucraina, Ue e Usa denunciano all…

কিন্তু যেহেতু আমার ইতালিয়ান ভাষার কমপ্রিহেনশন নাই, সেহেতু শুধু ধ্বনির উচ্চারন করেই এটাকে পড়ে ফেলেছি বললে নিজের সাথে প্রতারণাই করা হবে।


অথচ এই প্রতারণাই পুরো বিশ্বের তথাকথিত মুসলিমদাবীদাররা নিজেদের সাথে করে আসছে এবং এই আহাম্মকী কাজটার বৈধতা দিয়ে আসছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা।

বিষয় দেখলে মনে হয় আমরা পুরো মুসলিমদাবীদার জাতি নিজেদের কমনসেন্স টয়লেটে ফ্লাস করে দিয়ে আসছি।

একটা তোতাপাখিরে কেউ যদি “আই লাভ ইউ” ধ্বনিটা শিখায় এবং বাড়িতে মেহমান আসলে যদি পাখিটা “আই লাভ ইউ” বলে ওঠে সেক্ষেত্রে কোন পাগলেও বিশ্বাস করবে না যে পাখিটা সত্যিই তাকে ভালোবাসা জানাচ্ছে, কারন পাখিটার কোন কমপ্রিহেনশন নাই সে কি বলছে।

কমপ্রিহেনশন ছাড়া কিছু অক্ষর উচ্চারন কখনো ‘পড়া’ বলে কোয়ালিফাই করার কথা না!

অথচ যেখানে স্রষ্টা একটা জ্ঞানভিত্তিক বিধান পাঠালো যেটি ‘ইক্বরা’ বা ‘পড়’ নির্দেশনায় সূচনা, সেখানে আমরা সেই পড়ার বেসিক অর্থটাই গোলমাল পাকিয়ে বসে আছি, অর্থাৎ চরম লেভেলে যাকে বলে গোড়ায় গন্ডগোল।


এখন আসেন জিজ্ঞেস করি, Cui Bono, To whom is it a benefit? এই যে পড়ার নামে ফাইজলামি চলতেছে তাতে কে লাভবান হচ্ছে?

অবশ্যই আদম ও তার বংশধরদের যে চরম শত্রু, যার সম্পর্কে স্রষ্টা আমাদের সাবধান করেছে সেই বিপদগামী শয়তান সবচেয়ে বেশি লাভবান। কেননা আমরা বেকুবের মতো মনে করছি আমরা কুরআন পড়ি, অথচ পড়ি না। ধোঁকা দেওয়ার জন্য সচেতন ভুলকারীর চাইতে অসচেতন ভুলকারি ভালো না!

যে জানে যে – সে জানে না, বোঝে না; একে জানানো বা বুঝনো সম্ভব। আর যে জানে না, যে সে জানে না, শুধু তা না, জাহেল বা মুর্খের মতো ইনসিস্ট করে তার জানা হয়ে গেছে — তারে আপনি কেমনে জানাবেন বা বুঝাবেন? সেতো তার জানা ও বুঝার সকল সম্ভাবনার দরজায় খিল দিছে।


যে সংবিধান (কুরআন) দিয়ে জীবন গড়া ও সাজানোর কথা, যে বই গাইডেন্স, পথ দেখায়, নুর বা আলো, ফুরকান বা সত্য মিথ্যার প্রভেদকারী সেটাকে বুঝে না পড়তে দিয়ে, অবুঝ উচ্চারনকে এনকারেজ করে আমরা শয়তানের এজেন্ডাকেই সফল করছি। এর ফল কি হয়েছে যারা মুসলিম নামের দাবী করে তাদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। হায় আফসোস!


সহী ও শুদ্ধ করে ইতালিয়ান শব্দ পড়তে পারা অথচ অর্থের ব্যাপারে অন্ধকারে থাকলে — সে যতই গড়গড়িয়ে ইতালিয়ান পড়ে দিক, তাকে আমরা যেমন পড়া বলবো না; ঠিক তেমনি সহী ও শুদ্ধ করে কুরআন পড়ানো ‌শিক্ষা দেওয়া হয় বলে যারা ধর্মকে আয় ইনকামের জন্য ব্যবহার করে (অথচ সত্য কাজে কোন পারিশ্রমিক হয় না, এটাই স্রষ্টার শিক্ষা, এটাই কুরআনের প্রায়োগিক শিক্ষা) এবং মানুষকে সরাসরি কুরআন বুঝা থেকে নিরুৎসাহিত করার প্র্য‍াক্টিস জারি রাখে তারা জেনে অথবা না জেনে শয়তানের কাজকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আল্লাহতালা আমাদের এ ধরনের হেকমত বিবর্জিত, আনআম (চতুস্পদ জন্তু) টাইপের ধর্মবেত্তা ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের কবল থেকে মুক্তি এবং সত্যকে পূণাঙ্গভাবে বোঝার তাওফিক বৃদ্ধি করে দিন। নিশ্চই সত্যের মোকাবেলায় মিথ্যার কোন স্থান নেই এবং আজ হোক কাল হোক ধর্মব্যবসায়ীদের জাহিলিয়্যাত থেকে স্রষ্টার দ্বীণ (আদি ও অকৃত্রিম সনাতন পথ) মুক্ত হবে ও বিশ্ব মানবের মুক্তি মিলবে।


Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.