‘আল-আ’রাবু’ মানে আরবগণ; বেদুঈন নয়

আরবগণের চিরস্থায়ী কপটতা থেকে সাবধান!

আলোচ্য-সূচী
১. ভুমিকা
২. কুরআনে নিন্দিত ‘আরবগণ’ কীভাবে শুধুমাত্র ‘বেদুঈন’ হয়ে গেল?
৩. ‘বেদুঈন’ ও ‘মরুবাসী’ বুঝানোর জন্য কুরআনে আলাদা শব্দ আছে
৪. আরবগণ সম্পর্কিত ১০ টি আয়াতের সারসংক্ষেপ
৫. উপসংহার

ভুমিকা

মসজিদের মিম্বর, ওয়াজের জলসা বা মাহফিল, ইসলামী আন্দোলনের মঞ্চ আর তথাকথিত পীর-মুজাদ্দেদের দরবার থেকে আমজনতা কখনও কী এই জাতীয় বক্তব্য শুনতে পেয়েছে যে,-

ক. আরবজাতি কুফুরী ও মুনাফিকীতে বড়ই কঠোর ও সিদ্ধহস্ত
খ. আরবজাতি অজ্ঞ থাকতেই বদ্ধ পরিকর
গ. আরবগণ বড়ই মিথ্যাবাদী, আর
ঘ. আরবজাতি অলস, কর্মবিমুখ ইত্যাদি

সবগুলো প্রশ্নের সাধারণ উত্তর হবে- “না”।

অথচ এগুলো কুরআনে আরবজাতি সম্পর্কে আল্লাহর সুস্পষ্ট সাধারণ ঘোষণা। আল্লাহ যেমন এটিকে রাখঢাক না করে খোলাসা করেছেন, আমাদেরকে এটি জনসম্মুখে বলতে হবে; এর আলোচনা হতে হবে। এগুলো পরনিন্দা, পরচর্চা বা গীবত নয়।

এই আলোচনা এ জন্যে হতে হবে যে, আরবজাতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ মানবজাতির উদ্দেশ্যে জানিয়ে দেয়াটা আল্লাহ জরুরী মনে করে কুরআনের আয়াত করেছেন। সেই জাতি থেকে পৃথিবীর পুরো মুসলিম উম্মাহ এবং অন্যান্য জাতি যেন প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করতে পারে, তাই মানবজাতির বৃহত্তর কল্যানে শেষনবীকে যে জাতির কাছে পাঠিয়েছেন, তাদের আসল চেহারাটা ফাঁস করে দিয়েছেন।

কুরআনে আরবজাতির কথা বলতে গিয়ে ‘আরব’ শব্দের বহুবচন ‘আ’রাবু’ –এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় ১০ বার।

এর মধ্যে সূরা তওবার দু’টি আয়াতে ‘আল-আ’রাবু’-এর সাথে আলাদাভাবে মদীনাবাসীদের কথা বলা হয়েছে। ১০১ নং আয়াতে উভয় দলের মধ্য থেকে মুনাফিকীতে সিদ্ধহস্ত লোক রয়েছে বলে জানানো হয়। অর্থাৎ এখানে ‘আল-আ’রাবু’ বলতে মক্কার আরবগণকেই বোঝানো হয়েছে।

وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ

আর আরবদের মধ্যের যারা তোমাদের আশেপাশে আছে তাদের মধ্যে রয়েছে মুনাফিকরা, আবার মদীনার বাসিন্দাদের মধ্যেও- ওরা কপটতায় নাছোড়বান্দা। – ০৯ সূরা ত্বওবাহ: আয়াত ১০১

مَا كَانَ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُمْ مِنَ الْأَعْرَابِ أَنْ يَتَخَلَّفُوا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ وَلَا يَرْغَبُوا بِأَنْفُسِهِمْ عَنْ نَفْسِهِ

মদীনার বাসিন্দাদের ও তাদের আশপাশের আরবগণের জন্যে নয় যে তারা আল্লাহ্র রসূলের পিছনে থেকে যাবে, এবং নিজেদের জীবনকে তাঁর জীবনের চেয়ে বেশি প্রিয় মনে করাও নয়। -০৯ সূরা ত্বওবাহ: আয়াত ১২০

শেষনবী নিজে একজন আরব এবং তাঁর কাছে যে কুরআন নাযিল হয়েছে তা তাঁর নিজ আরবী ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে – সে সংক্রান্ত বিবৃতি বহু।

শেষনবীর ‘আরব’ জাতিসত্তাকে বোঝাতে কুরআনে ব্যবহৃত ‘আরাবিয়্যু’-এর অনুবাদে ইসলামিক ফাউন্ডেশন লিখেছে, “অথচ রাসূল আরবীয়”।

وَلَوْ جَعَلْنَاهُ قُرْآَنًا أَعْجَمِيًّا لَقَالُوا لَوْلَا فُصِّلَتْ آَيَاتُهُ أَأَعْجَمِيٌّ وَعَرَبِيٌّ

আমি যদি ‘আজমী ভাষায় কুরাআন অবতীর্ণ করিতাম তবে উহারা অবশ্যই বলিত, ‘ইহার আয়াতগুলি বিশদভাবে বিবৃত হয় নাই কেন? কি আশ্চর্য যে, ইহার ভাষা ‘আজমী, অথচ রাসূল আরবীয়! -৪১:৪৪ (ইফা)

কুরআনান আরাবিয়্যা (قُرْآَنًا عَرَبِيًّا)
তেমনিভাবে আরবী কুরআন বা আরবী ভাষায় কুরআন বলতে কুরআনে “কুরআনান আরাবিয়্যা (قُرْآَنًا عَرَبِيًّا)” ব্যবহার করা হয়েছে বহু জায়গায়। কোথাও এটাকে ‘হুকমান আরাবিয়্যা’ বা ‘লিসানুন আরাবিয়্যুও’ বলা হয়েছে।

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

নিঃসন্দেহ আমরা এটি অবতারণ করেছি- আরবী কুরআন, যেন তোমরা বুঝতে পার। -১২:২

وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ حُكْمًا عَرَبِيًّا

আর এইভাবে আমরা এটি অবতারণ করেছি- একটি হুকুম আরবীতে। – ১৩:৩৭

وَلَقَدْ نَعْلَمُ أَنَّهُمْ يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ لِسَانُ الَّذِي يُلْحِدُونَ إِلَيْهِ أَعْجَمِيٌّ وَهَذَا لِسَانٌ عَرَبِيٌّ مُبِينٌ

আর আমরা অবশ্যই জানি যে তারা বলে– নিঃসন্দেহ তাঁকে তো কোনো এক মানুষ শেখায়। ওরা যার প্রতি ইঙ্গিত করে তার ভাষা ভিন্নদেশীয়, অথচ এটি পরিস্কার আরবী ভাষা। -১৬:১০৩

وَكَذَلِكَ أَنْزَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا وَصَرَّفْنَا فِيهِ مِنَ الْوَعِيدِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ أَوْ يُحْدِثُ لَهُمْ ذِكْرًا

আর এইভাবেই আমরা এটি অবতারণ করেছি- একখানি আরবী কুরআন, আর তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী- গুলো থেকে যেন তারা ধর্মপরায়ণতা অবলন্বন করে, অথবা এটি যেন গুণকীর্তনে তাদের উপদেশ দান করে। -২০:১১৩

بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُبِينٍ

সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়। -২৬:১৯৫

قُرْآَنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

আরবী কুরআন, কোনো জটিলতা বিহীন, যেন তারা ধর্মভীরুতা অবলন্বন করতে পারে। -৩৯:২৮

كِتَابٌ فُصِّلَتْ آَيَاتُهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ

একটি গ্রন্থ যার আয়াতসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত, আরবী কুরআন সেই লোকদের জন্য যারা জানে। – ৪১:৩

وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لِتُنْذِرَ أُمَّ الْقُرَى وَمَنْ حَوْلَهَا وَتُنْذِرَ يَوْمَ الْجَمْعِ لَا رَيْبَ فِيهِ

আর এইভাবে আমরা তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ দিয়েছি এই ভাষণ আরবীতে যেন তুমি নগর-জননী ও তার আশেপাশে যারা রয়েছে তাদের সতর্ক করতে পার, আর যেন তুমি সতর্ক করতে পার জমায়েৎ হওয়ার দিন সম্পর্কে- যাতে কোনো সন্দেহ নেই। -৪২:৭

إِنَّا جَعَلْنَاهُ قُرْآَنًا عَرَبِيًّا لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

নিঃসন্দেহ আমরা এটিকে এক আরবী ভাষণ করেছি যেন তোমরা বুঝতে পারো। – ৪৩ সূরা যুখরুফ: আয়াত ০৩

وَمِنْ قَبْلِهِ كِتَابُ مُوسَى إِمَامًا وَرَحْمَةً وَهَذَا كِتَابٌ مُصَدِّقٌ لِسَانًا عَرَبِيًّا لِيُنْذِرَ الَّذِينَ ظَلَمُوا وَبُشْرَى لِلْمُحْسِنِينَ

আর এর আগে ছিল মুসার গ্রন্থ- অগ্রদূত ও করুণাস্বরূপ। আর এখানা হচ্ছে সত্যসমর্থনকারী কিতাব, আরবী ভাষায়, যেন এটি সতর্ক করতে পারে তাদের যারা অন্যায়াচরণ করছে, এবং সৎকর্মশীলদের জন্য হতে পারে সুসংবাদ স্বরূপ। -৪৬:১২

আরাবিয়্যুন-এর অর্থ আরবী এবং কুরআনান আরাবিয়্যুন মানে আরবী কুরআন – এটা লিখতে কোন অনুবাদকই কোনরকম কার্পণ্য করেন নি। কিন্তু এর বহুবচনে যখন ‘আল-আ’রাবু’ ব্যবহার করা হয়েছে তখনই কোন যাদুবলে তা আরবগণ না হয়ে কীভাবে যেন বেদুঈন আর মরুবাসী হয়ে গেল।

কুরআনে নিন্দিত ‘আরবগণ’ কীভাবে শুধুমাত্র ‘বেদুঈন’ হয়ে গেল?

বিদ্যমান অলীক ও ভ্রান্ত বাস্তবতাঃ কুরআনের পাঠকগণ, বাংলা কিংবা ইংরেজী কোথাও ‘আ’রাবুর’ সঠিক অর্থ দেখতে পাবেন না। এখানে বিকৃতি অনেক ব্যাপক ও অতি পুরানো। অভিধানেই এই অর্থকে অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে; একটা ধোয়াশা তৈরি করা হয়েছে।

কুরআনের যে দশটি জায়গায় ‘আল-আ’রাবু’ ব্যবহার করা হয়েছে, অনুবাদকগণ সেখানে ‘আরবগণ’ না লিখে অর্থ করেছেন ‘গ্রাম্য’ ‘বেদুঈন’, ‘মরুবাসী’, ‘যাযাবর’ এবং ইংরেজীতে The Bedouin, Wandering Arabs, Dwellers of the Desert ইত্যাদি।

আরবগণের অর্থ বরাবরই অতি ধূর্ত আরবগণের পরিবর্তে বেদুঈনদের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। আর অনুবাদকারীগণের সাথে যেন আরব সম্প্রদায়ের কোন এক অলিখিত গোপন চুক্তি সম্পন্ন হয়ে আছে যে, যার বদৌলতে তারা এর অর্থ আরবগণের দিকে না দিয়ে মরুবাসী বা বেদুঈনদের দিকেই নিয়ে যায়।

যে আরবজাতির ব্যাপক নিন্দা করা হয়েছে, তাদেরকে আল্লাহর লেপনকৃত কালিমা থেকে বাচাতে পারলেই যেন এক মহা কল্যাণের কাজ সম্পন্ন হয়।

কুরআন অনুবাদের ক্ষত্রে উপরিউক্ত ভুলটি শুধুমাত্র ইসলামিক ফাউন্ডেশনের না; বাংলা, ইংরেজীসহ প্রায় সকল অনুবাদকগণই এই ঐতিহাসিক গলদটিকে এড়াতে পারেন নি। ইফা এ সংক্রান্ত প্রতিটি অনুবাদেই আরবগণ না লিখে ‘মরুবাসী’ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। মরুবাসী বললে আরবদের ঘাড় থেকে অনেকটাই দোষ স্খালনের সুযোগ থেকে যায়। শুধুমাত্র সূরা হুজুরাতের ১৪ নং আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে ইফা ‘বেদুঈন’ লিখেছে।

যুক্তি দেখানো যেতে পারে মরুর অধিবাসীরা তো আরব জাতিই- সেক্ষেত্রে পাল্টা যুক্তিও আছে। যদি তাই হয় তাহলে সরাসরি ‘আ’রাবু’ অর্থ আরবজাতি বলতে আর সমস্যা কোথায়?

কুরআন বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়বার প্রাক্কালেই আরবজাতি এই ভুলটিকে চারিদিকে সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল এক সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে। তারা নিজেদের কাধে এত এত বদনামের বোঝা নিতে চায় নি।

তারা সকল অপবাদ আর দোষ তাদেরই মধ্যে বসবাসকারী বেদুঈন, যাযাবর শ্রেণীদের উপর চাপিয়ে স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক উদ্ঘাটিত এবং কুরআনের আয়াত হিসেবে নাযিলকৃত নিজেদের কুৎসিত চেহারাটিকে পৃথিবীবাসী থেকে ঢেকে দিতে চেয়েছিল। অথচ দশটি আয়াতের মধ্যে একটি আয়াতে তাদের গুণকীর্তনও করা হয়েছে। কিন্তু তারা কোন ঝুঁকিই নিতে চায় নি।

তারা চিন্তা করেছে – প্রশংসা দরকার নেই, আগে অপবাদের বিপদ থেকে বাঁচি- তাই প্রশংসাকে কুরবানী দিয়ে নিন্দার কাঁটা থেকে বাচার মনোবৃত্তি থেকে আরবগণ একেবারে গোড়াতেই এর অর্থ পাল্টে ফেলেছে।

অভিধান কী বলে?
আরাবিয়্যু বা আরাবিয়্যা মানে আরবীয়; আরব দেশের বাসিন্দা; আরবী। ইংরেজী অভিধানে সংক্ষেপে দেয়া আছে Desert Arabs। সূত্রঃ ARABIC-ENGLISH: DICTIONARY OF QUR’ANIC USAGE

“আল্লামা রাগিম ইস্পাহানী আল মুফরাদাতুল কুরআনে লিখেছেন- হযরত ইসমাইল (আ)-এর বংশধরকে আরাবুন বলা হয়। শব্দটি একবচন। বহুবচনে- আ’রাবু

কাজী শওকানী তাফসীরে ফাতহুল কাদীরে সূরা তওবায় লিখেছেন, যারা মুরুভূমিতে বসবাস করে তাদেরকে আ’রাবু বলা হয়। আরবের বালুকাময় ভূমিতে যারা বসবাস করেন তাদের সবাই আরাবুন। চাই তারা শহরে বসবাস করুন কিংবা গ্রামে অথবা মরু এলাকায়।“ (সূত্রঃ আল কুরআনের অভিধান; বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)

আশ্চর্যের বিষয় হল, উপরিউক্ত ব্যাখ্যা দানের পরও উক্ত অভিধানের শুরুতে লেখা হয়েছে -আ’রবু মানে “গ্রাম্য; বেদুঈন; যাযাবর”।

‘বেদুঈন’ ও ‘মরুবাসী’ বুঝানোর জন্য কুরআনে আলাদা শব্দ আছে

অনুবাদকগণ ‘আল-আ’রাবু’-এর অর্থ বেদুঈন করেছেন, অথচ কুরআনে সুস্পষ্ট আয়াত রয়েছে যেখানে ‘আল-আ’রাবু’-এর সাথে যুক্ত করেই ‘বাদিউন’ বা বেদুঈন-এর প্রয়োগ রয়েছে (৩৩:২০)।

আবার অন্যত্র গ্রাম্য জীবন বা জঙ্গল, বন-বনানী বুঝাতেও ‘বাদউন’ -এর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় (১২:১০০)।

يَوَدُّوا لَوْ أَنَّهُمْ بَادُونَ فِي الْأَعْرَابِ يَسْأَلُونَ عَنْ أَنْبَائِكُمْ

তবে তারা কামনা করবে যে, যদি তারা বেদুঈন আরবগণের মধ্য থেকে তোমাদের সংবাদাদি জেনে নিত। -৩৩:২০

They will wish that they were desert-dwellers among the Bedouins asking for news of you. – Arberry

These [hypocrites] would prefer to be in the desert, among the bedouin, asking for news about you. – Asad

লক্ষ্যনীয় যে, এখানে আ’রাবু’-এর পূর্বে একটা অতিরিক্ত ‘বাদুনা’ ব্যবহার করে বলা হয়েছে ‘বাদুনা ফিল আ’রাবি (بَادُونَ فِي الْأَعْرَابِ)’ – যার মানে ‘আরবগণের মধ্যের বেদুঈন বা যাযাবর’। এখানে ‘বাদুনা’ অর্থ বেদুঈন।

এখান থেকে অত্যন্ত স্পষ্ট যে যেখানে বেদুঈনদের আলাদা করে বুঝানোর প্রয়োজন হয়েছে সেখানে সেটা করা হয়েছে। তাই ‘আ’রাবু’-এর অর্থ বেদুঈন বলে চালিয়ে দেবার কোন সুযোগ নেই।

‘বাদউন’ দ্বারা গ্রাম্য বা মরু অঞ্চলও বুঝায়
হযরত ইউসূফ তাঁর মহান পিতা হযরত ইয়াকুবকে উদ্দেশ্য করে বলেন-

وَقَدْ أَحْسَنَ بِي إِذْ أَخْرَجَنِي مِنَ السِّجْنِ وَجَاءَ بِكُمْ مِنَ الْبَدْوِ مِنْ بَعْدِ أَنْ نَزَغَ الشَّيْطَانُ بَيْنِي وَبَيْنَ إِخْوَتِي

আর তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছিলেন যখন তিনি আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেছিলেন, এবং মরুভূমি বা গ্রাম থেকে (brought you all from the village /the bedouin life) আপনাদের নিয়ে এসেছেন আমার মধ্যে ও আমার ভাইয়ের মধ্যে শয়তান বিরোধ বাধাবার পরে। -১২:১০০

কতিপয় ইংরেজী অনুবাদকগণের শব্দচয়ন আমরা পরীক্ষা করতে পারি।

He was gracious in getting me out of the prison, and bringing you out of the desert to me after the discord created by Satan between me and my brothers. – Ahmed Ali

And indeed He has bestowed favour upon me, when He brought me out of prison and brought you all from the village, after Satan had created a resentment between me and my brothers. – Ahmed Raza Khan

He was good to me when He brought me forth from the prison, and again when He brought you out of the desert, after that Satan set at variance me and my brethren. – Arberry

আবার অন্যদিকে ‘মরুবাসী’ বুঝানোর জন্য আলাদা শব্দ ‘মুকবীন’-এর ব্যবহারও দেখতে পাওয়া যায়।

نَحْنُ جَعَلْنَاهَا تَذْكِرَةً وَمَتَاعًا لِلْمُقْوِينَ

আমরাই তাকে বানিয়েছি এক নিদর্শনসামগ্রী এবং মরুচারীদের জন্য এক প্রয়োজনসামগ্রী। -৫৬:৭৩

We Ourselves made it for a reminder, and a boon to the desert-dwellers. – Arberry

We have made it a memorial (of Our handiwork), and an article of comfort and convenience for the denizens of deserts. -Yusuf Ali

We have made it a reminder and an advantage for the wayfarers of the desert. – Shakir

আরবগণ সম্পর্কিত ১০ টি আয়াতের সারসংক্ষেপ

আরবগণের স্বভাব-চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে যে ১০ টি তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত আল্লাহ ব্যবহার করেছেন অতি সংক্ষেপে সেই চরিত্র চিত্রনগুলো দেখে নেয়া যাক,-

এক. আরবজাতি মিথ্যাবাদী যারা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য খোঁড়া অজুহাত পেশ করেছিল নবীজির কাছে।

আত-তাওবাহ ৯:৯০

وَجَآءَ ٱلْمُعَذِّرُونَ مِنَ ٱلْأَعْرَابِ لِيُؤْذَنَ لَهُمْ وَقَعَدَ ٱلَّذِينَ كَذَبُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥۚ سَيُصِيبُ ٱلَّذِينَ كَفَرُوا۟ مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

আরবদের থেকে ওযর পেশকারীরা আসল, যেন তাদের অনুমতি দেয়া হয় এবং (জিহাদ না করে) বসে থাকল তারা, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে মিথ্যা বলেছিল। তাদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে, তাদেরকে অচিরেই যন্ত্রণাদায়ক আযাব আক্রান্ত করবে।

দুই. আরবগণ কুফর ও মোনাফেকীতে অত্যন্ত কঠোর হয়ে থাকে; আর আল্লাহ তাঁর রাসূলের কাছে যা অবতারণ করেছেন তার চৌহদ্দি না জানার প্রতিই বেশী অনুরক্ত। তাহার সীমারেখা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার যোগ্যতা ইহাদের অধিক।

আত-তাওবাহ ৯:৯৭

ٱلْأَعْرَابُ أَشَدُّ كُفْرًا وَنِفَاقًا وَأَجْدَرُ أَلَّا يَعْلَمُوا۟ حُدُودَ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ رَسُولِهِۦۗ وَٱللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

আরবরা কুফর ও কপটতায় কঠিনতর এবং আল্লাহ তাঁর রাসূলের উপর যা নাযিল করেছেন তার সীমারেখা না জানার অধিক উপযোগী। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, প্রজ্ঞাময়।

♦অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই চরিত্র চিত্রন। 
আরববাসীদের এই চরিত্রের সাক্ষাত আজও আমরা পাই অবিকৃতভাবেই।

তিন. আবার কোন কোন আরব এমনও রয়েছে যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ব্যয় করাকে জরিমানা মনে করে।

আত-তাওবাহ ৯:৯৮

وَمِنَ ٱلْأَعْرَابِ مَن يَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ مَغْرَمًا وَيَتَرَبَّصُ بِكُمُ ٱلدَّوَآئِرَۚ عَلَيْهِمْ دَآئِرَةُ ٱلسَّوْءِۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

আর আরবদের কেউ কেউ যা (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে, তা জরিমানা গণ্য করে এবং তোমাদের দুর্বিপাকের প্রতীক্ষায় থাকে। দুর্বিপাক তাদের উপরই এবং আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞানী।

চার. আল্লাহর শেষনবীর আশেপাশে তাঁর বিশ্বস্ত ছাহাবী হিসেবে বিদ্যমান মক্কা থেকে আগত মুহাজির এবং মদীনাবাসীদের মধ্য থেকে এক দল ছিল যারা প্রকৃতপক্ষে মু’মিন তো ছিলই না; বরং তারা মুনাফিকীতে ছিল সিদ্ধহস্ত। এই বিষয়ে আল্লাহ পরিস্কার ভাবে বলেছেন যে, সেই মুনাফিক শ্রেণিটি এতটাই চতুর ও নিজেদের আসল চেহারা লুকাতে এতটাই পারঙ্গম যে, স্বয়ং রাসূল তাদেরকে চিনতে পারেন নাই, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।

আত-তাওবাহ ৯:১০১

وَمِمَّنْ حَوْلَكُم مِّنَ ٱلْأَعْرَابِ مُنَٰفِقُونَۖ وَمِنْ أَهْلِ ٱلْمَدِينَةِۖ مَرَدُوا۟ عَلَى ٱلنِّفَاقِ لَا تَعْلَمُهُمْۖ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْۚ سَنُعَذِّبُهُم مَّرَّتَيْنِ ثُمَّ يُرَدُّونَ إِلَىٰ عَذَابٍ عَظِيمٍ

আর তোমাদের আশপাশের আরবদের মধ্যে কিছু লোক মুনাফিক এবং মদীনাবাসীদের মধ্যেও কিছু লোক অতিমাত্রায় মুনাফিকীতে লিপ্ত আছে। তুমি তাদেরকে জান না। আমি তাদেরকে জানি। অচিরে আমি তাদেরকে দু’বার আযাব দেব তারপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে মহাআযাবের দিকে।

পাঁচ. মদীনাবাসী ও পাশ্ববর্তী আরবরা রাসূল সাঃ এর জীবন অপেক্ষা তাদের জীবন কে প্রিয় মনে যুদ্ধে অংশগ্রহন না করে পেছনে থেকে গিয়েছিল যা তাদের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।

আত-তাওবাহ ৯:১২০

مَا كَانَ لِأَهْلِ ٱلْمَدِينَةِ وَمَنْ حَوْلَهُم مِّنَ ٱلْأَعْرَابِ أَن يَتَخَلَّفُوا۟ عَن رَّسُولِ ٱللَّهِ وَلَا يَرْغَبُوا۟ بِأَنفُسِهِمْ عَن نَّفْسِهِۦۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ لَا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلَا نَصَبٌ وَلَا مَخْمَصَةٌ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ وَلَا يَطَـُٔونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ ٱلْكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَّيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِۦ عَمَلٌ صَٰلِحٌۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ ٱلْمُحْسِنِينَ

মদীনার অধিবাসী ও তার আশপাশের আরবদের জন্য সংগত নয় যে, রাসূলুল্লাহ্ থেকে পেছনে থেকে যাবে এবং রাসূলের জীবন অপেক্ষা নিজদের জীবনকে অধিক প্রিয় মনে করবে। এটা এ কারণে যে, তাদেরকে আল্লাহর পথে তৃষ্ণা, ক্লান্তি ও ক্ষুধায় আক্রান্ত করে এবং তাদের এমন পদক্ষেপ যা কাফিরদের ক্রোধ জন্মায় এবং শত্রুদেরকে তারা ক্ষতিসাধন করে, তার বিনিময়ে তাদের জন্য সৎকর্ম লিপিবদ্ধ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।

ছয়. কপট আরবগণ কামনা করে যে, যদি তারা বেদুঈন আরবগণের মধ্য থেকে মু’মিনদের সংবাদাদি জেনে নিত, তবেই ভাল হত। এই মুনাফিক শ্রেণী মু’মিনদের মধ্যে অবস্থান করলেও যুদ্ধ সামান্যই করত– সে বিষয়টিও পরিস্কার জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

আল-আহযাব ৩৩:২০

يَحْسَبُونَ ٱلْأَحْزَابَ لَمْ يَذْهَبُوا۟ۖ وَإِن يَأْتِ ٱلْأَحْزَابُ يَوَدُّوا۟ لَوْ أَنَّهُم بَادُونَ فِى ٱلْأَعْرَابِ يَسْـَٔلُونَ عَنْ أَنۢبَآئِكُمْۖ وَلَوْ كَانُوا۟ فِيكُم مَّا قَٰتَلُوٓا۟ إِلَّا قَلِيلًا

তারা মনে করে, সম্মিলিত বাহিনী চলে যায়নি। তবে সম্মিলিত বাহিনী* যদি এসে পড়ে তখন তারা কামনা করবে যে, নিশ্চয় যদি তারা মরুবাসী আরবদের মধ্যে অবস্থান করে তোমাদের খবর জিজ্ঞাসা করতে পারত [তবে ভালই হত]! আর যদি এরা তোমাদের মধ্যে থাকত তাহলে তারা অল্পই যুদ্ধ করত।

সাত. আরবগণের মধ্যে যারা গৃহে বসে রয়েছে, তারা নবীকে মিথ্যা বলে যে তাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন তাদের ব্যস্ত রেখেছিল। তারা মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই।

আল-ফাত্‌হ ৪৮:১১

سَيَقُولُ لَكَ ٱلْمُخَلَّفُونَ مِنَ ٱلْأَعْرَابِ شَغَلَتْنَآ أَمْوَٰلُنَا وَأَهْلُونَا فَٱسْتَغْفِرْ لَنَاۚ يَقُولُونَ بِأَلْسِنَتِهِم مَّا لَيْسَ فِى قُلُوبِهِمْۚ قُلْ فَمَن يَمْلِكُ لَكُم مِّنَ ٱللَّهِ شَيْـًٔا إِنْ أَرَادَ بِكُمْ ضَرًّا أَوْ أَرَادَ بِكُمْ نَفْعًۢاۚ بَلْ كَانَ ٱللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًۢا

পিছনে পড়ে থাকা বেদুঈনরা তোমাকে অচিরেই বলবে, ‘আমাদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল; অতএব আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’ তারা মুখে তা বলে যা তাদের অন্তরে নেই। বল, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের কোন ক্ষতি করতে চান কিংবা কোন উপকার করতে চান, তবে কে আল্লাহর মোকাবিলায় তোমাদের জন্য কোন কিছুর মালিক হবে’? বরং তোমরা যে আমল কর আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।’

আট. আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করে গৃহে অবস্থানকারী আরবদের আল্লাহর পক্ষ থেকে হুশিয়ারী করা হচ্ছে যে, তাদেরকে আগামীতে আরও বড় যুদ্ধ মোকাবেলা করে তাদের ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। আর তখনও যদি তারা পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর যেমন ইতিপূর্বে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছ, তবে তিনি তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি দিবেন।

আল-ফাত্‌হ ৪৮:১৬

قُل لِّلْمُخَلَّفِينَ مِنَ ٱلْأَعْرَابِ سَتُدْعَوْنَ إِلَىٰ قَوْمٍ أُو۟لِى بَأْسٍ شَدِيدٍ تُقَٰتِلُونَهُمْ أَوْ يُسْلِمُونَۖ فَإِن تُطِيعُوا۟ يُؤْتِكُمُ ٱللَّهُ أَجْرًا حَسَنًاۖ وَإِن تَتَوَلَّوْا۟ كَمَا تَوَلَّيْتُم مِّن قَبْلُ يُعَذِّبْكُمْ عَذَابًا أَلِيمًا

পেছনে পড়ে থাকা বেদুঈনদেরকে বল, ‘এক কঠোর যোদ্ধা জাতির বিরুদ্ধে শীঘ্রই তোমাদেরকে ডাকা হবে; তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে অথবা তারা আত্মসমর্পণ করবে। অতঃপর তোমরা যদি আনুগত্য কর তবে আল্লাহ তোমাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেবেন। আর পূর্বে তোমরা যেমন ফিরে গিয়েছিলে তেমনি যদি ফিরে যাও তবে তিনি তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব দেবেন।

নয়. আরবগণের অনেকেই ঈমান আনয়ণের মিথ্যা শপথ করে, অথচ পরিস্থতির চাপে পড়ে কেবলমাত্র তারা বশ্যতা স্বীকার করেছে।

আল-হুজরাত ৪৯:১৪

قَالَتِ ٱلْأَعْرَابُ ءَامَنَّاۖ قُل لَّمْ تُؤْمِنُوا۟ وَلَٰكِن قُولُوٓا۟ أَسْلَمْنَا وَلَمَّا يَدْخُلِ ٱلْإِيمَٰنُ فِى قُلُوبِكُمْۖ وَإِن تُطِيعُوا۟ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ لَا يَلِتْكُم مِّنْ أَعْمَٰلِكُمْ شَيْـًٔاۚ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

আরবরা বলল, ‘আমরা ঈমান আনলাম’। বল, ‘তোমরা ঈমান আননি’। বরং তোমরা বল, ‘আমরা আত্মসমর্পণ করলাম’। আর এখন পর্যন্ত তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি। আর যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, তাহলে তিনি তোমাদের আমলসমূহের কোন কিছুই হ্রাস করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

উপরের আয়াত গুলো মূলত মুনাফিকদের সামগ্রিক চারিত্রেক বৈশিষ্ঠ্যের কথামালা।

♦এই ধারাবাহিক থেকে একটি আয়াত বাদ রাখা হয়েছিল যা এখন উল্লেখ করা হচ্ছে। ‘আল-আ’রাবু’ বা আরবগণের কথা উল্লেখ করে একমাত্র এই আয়াতেই তাদের প্রশংসা করা হয়েছে।

দশ. আরবগণের মত এত বেয়াড়া ও বিপরীত স্রোতের মানুষের মধ্য থেকে এমন কিছু আল্লাহর বান্দাও রয়েছেন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নৈকট্য লাভের জন্য ঈমানের প্রয়োজনীয় দাবী পূরণে মোটেই পিছপা হয় না। কাজে কাজেই আল্লাহও তাদেরকে তাঁর নিজ রহমত ও করুণায় অন্তর্ভুক্ত করার উদাত্ত ঘোষণা দেন।

আত-তাওবাহ ৯:৯৯

وَمِنَ ٱلْأَعْرَابِ مَن يُؤْمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْءَاخِرِ وَيَتَّخِذُ مَا يُنفِقُ قُرُبَٰتٍ عِندَ ٱللَّهِ وَصَلَوَٰتِ ٱلرَّسُولِۚ أَلَآ إِنَّهَا قُرْبَةٌ لَّهُمْۚ سَيُدْخِلُهُمُ ٱللَّهُ فِى رَحْمَتِهِۦٓۗ إِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

আর আরবদের কেউ কেউ আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং যা ব্যয় করে তাকে আল্লাহর নিকট নৈকট্য ও রাসূলের দো‘আর উপায় হিসেবে গণ্য করে। জেনে রাখ, নিশ্চয় তা তাদের জন্য নৈকট্যের মাধ্যম। অচিরেই আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমতে প্রবেশ করাবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।

উপসংহার

আল্লাহ মানবজাতির উদ্দেশ্যে কুরআন নাযিল করেছেন যেন তারা সকল অন্ধকার থেকে এক আল্লাহর আলোর দিকে আসতে পারে তারই হুকুমে। আর সেই কুরআনকে করেছেন সকল প্রকার বক্রতামুক্ত। একই সাথে আল্লাহ কুরআন থেকে উপদেশ গ্রহণ সহজ করেছেন।

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا

সকল প্রশংসা আল্লাহ্র যিনি তাঁর বান্দার কাছে এই কিতাব অবতারণ করেছেন, আর তিনি এতে কোনো কুটিলতা রাখেন নি। -১৮:১

قُرْآَنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ

আরবী কুরআন, কোনো জটিলতা বিহীন, যেন তারা ধর্মভীরুতা অবলন্বন করতে পারে। -৩৯:২৮

কুরআনকে আমাদের পক্ষে বিকৃত বা বিনষ্ট করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু কুরআনের আয়াতের অর্থে যে মানুষ বক্রতা অন্বেষণ করবে এবং শব্দগুলোকে বাক্যে ব্যবহৃত অর্থের চেয়ে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে সে সংক্রান্ত সতর্ককারী আয়াত কুরআনেই রয়েছে।

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لِمَ تَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ مَنْ آَمَنَ تَبْغُونَهَا عِوَجًا وَأَنْتُمْ شُهَدَاءُ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ

বলো- হে গ্রন্থধারিগণ! কেন তোমরা যারা ঈমান এনেছে তাদের আল্লাহ্র পথ থেকে প্রতিরোধ করো, তোমরা তার বক্রতা খোঁজো, অথচ তোমরা সাক্ষী রয়েছ? আর আল্লাহ গাফিল নন তোমরা যা করো সে-সন্বন্ধে। -৩:৯৯

الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُمْ بِالْآَخِرَةِ كَافِرُونَ

যারা আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে দেয় আর তাকে কুটিল করতে চেষ্টা করে, আর তারা আখেরাতের সন্বন্ধে অবিশ্বাসী। -৭:৪৫

الَّذِينَ يَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا وَهُمْ بِالْآَخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ

যারা আল্লাহ্র পথ থেকে ফিরিয়ে রাখে এবং একে করতে চায় কুটিল? আর এরা নিজেরাই পরকাল সন্বন্ধে অবিশ্বাসী। -১১:১৯

الَّذِينَ يَسْتَحِبُّونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآَخِرَةِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ وَيَبْغُونَهَا عِوَجًا أُولَئِكَ فِي ضَلَالٍ بَعِيدٍ

যারা পরকালের উপরি এই দুনিয়ার জীবনটাকেই বেশী ভালোবাসে, আর আল্লাহ্র পথ থেকে নিবৃত্ত করে, আর একে করতে চায় কুটিল। এরাই রয়েছে সুদূর-প্রসারিত ভ্রান্তিতে। -১৪:৩

অন্যত্র বলা হয়েছে-
وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِنْ بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

এরপর কি তোমরা আশা কর যে তারা তোমাদের প্রতি বিশ্বাস করবে? ইতিপূর্বে তাদের একটি দল আল্লাহর বাণী শুনত, তারপর তা পাল্টে দিত উহা বুঝবার পরেও, আর তারা জানে। -২:৭৫

يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ وَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ

তারা কালামগুলো তাদের স্থান থেকে সরিয়ে দেয়, আর তাদের যে-সব নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তার অংশবিশেষ ভুলে যায়। -৫:১৩

সুতরাং কুরআনী শব্দের অর্থ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে করা বা তাতে বক্রতা অন্বেষণ করা এবং কুরআনী আয়াতের মতলবী অর্থ করা মানুষের মজ্জাগত। সকল যুগের সকল নবীর উম্মতগণের মধ্যকার কপট-মুনাফিক শ্রেণী এই জঘণ্য কাজগুলো করে এসেছে। কিন্তু একই সাথে আল্লাহ তা’য়ালা তার সমাধান সূত্র কুরআনের মধ্যেই বিদ্যমান রেখেছেন।

কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানবজাতির জন্য চক্ষু উন্মোচনকারী।

هَذَا بَصَائِرُ لِلنَّاسِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ

এটা হচ্ছে মানবজাতির জন্য দৃষ্টিদায়ক, আর পথপ্রদর্শক ও করুণা সেই সম্প্রদায়ের জন্য যারা সুনিশ্চিত বিশ্বাসী। -৪৫:২০


Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.