ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের সাথে যে আচরণ অবশ্যই পরিতাজ্য

আমরা মুসলিম ভাইরা পারস্পরিক নিজেদের দ্বীনের কথা, উপকারী কথা স্মরণ করিয়ে দিবো, এটা ঈমানেরই একটা দাবি। কিন্তু কাউকে অপ্রয়োজনীয় ও অযাচিত উপদেশ দেয়াও উচিত নয়। আমাদের সমাজে ‘নিজেকে ধার্মিক মনে করা’ লোকেরা এই কাজটাই খুব বেশি করে করে। ভুল জায়গায় ভুল সময়ে ভুল উপদেশ বিতরণ করে বেড়ানো তো ইসলামিক আচরণ নয়ই, বরং তা ইসলামি সংস্কৃতি ও নীতির বিরোধী। কুরআন-হাদিসের বাণী কোনো অস্ত্র না যে এগুলো শুনিয়ে অন্যদের ওপর নিজের কর্তৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে হবে। এতে করে হয়ত একজন মুসলিমকে আহত-অপমান-হতাশায় ফেলে দুর্দশাগ্রস্ত করায় শাস্তি নির্ধারণ হয়ে যাবে আমাদেরই কারো জীবনে। অন্যদের অযাচিত সাহায্যের আগে নিজের কল্যাণের দিকে তাকানো উচিত কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের হিসাব নিবেন।

বিশেষ করে, কেউ যখন ডিপ্রেসড থাকে, তার অবস্থা আসলে তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না বলেই সে ডিপ্রেশনে ভুগে। কেউ শখ করে কষ্ট পেতে, যন্ত্রণায় ভুগতে চায় না। তাই কেউ যদি এমন খারাপ অবস্থায় থাকে, তার উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, প্রয়োজনে কাউন্সেলিং করানো উচিত কিংবা ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। এ তো গেলো যিনি ভুগছেন তার কথা, আমাদের করণীয় কী?

আমাদের অবশ্যই একজন ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের সাথে যে কথাগুলো বলা উচিত না তা হলো-

১) “জীবনের ভালো বিষয়গুলোর দিকে দেখো” 

– ভাইরে! সে তো ভালো দিক ত সে দেখতে পাচ্ছে না বলেই সে বিষণ্ণ, ডিপ্রেসড। এভাবে করে তাকে আসলে জাজমেন্ট করা হয়, তা প্রতি অন্যায় করা হয়। এভাবে করে তাকে বুঝানো হয় যে সে জীবনের ভালো দিকগুলো দেখতে পায় না, সে আসলে অকৃতজ্ঞ। ব্যাপারটা এমন যে একজন অন্ধকে বলা হচ্ছে “সূর্যের দিকে তাকাও”।

২) “সবর করো, ধৈর্য ধরো!” 

– কেউ যদি ডিপ্রেসড থাকে, তাকে যদি বলতে থাকা হয় যে “ধৈর্য ধরো… ধৈর্য ধরো”– এটা এক ধরনের জাজমেন্ট করা হয়। বলেই দেয়া হচ্ছে ইঙ্গিতে যে সে সবর করছে না, যে ধৈর্যহীন। কেউ যদি ক্যান্সারের রোগী হয়, তাকে কি ধৈর্য ধরতে বলার কথা, নাকি চিকিৎসা নিতে বলার কথা?

৩) “এই দোয়া পড়ো, ঐ দোয়া পড়ো…” 

– দু’আ করলে, আল্লাহর স্মরণ করলে তা অবশ্যই মানুষের হৃদয়কে প্রশান্ত করে, মনের শান্তির কারণ হয়। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন “যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর যিকির দ্বারাই অন্তর সমূহ শান্তি পায়।” [১]। কিন্তু কেউ যখন ডিপ্রেসড, তাকে গিয়ে যখন অন্য কেউ বলতে থাকেন, “এই দোয়া পড়ো, ঐ দোয়া পড়ো…” এই কাজটা ঠিক না। এই আচরণের মধ্যে একটা জাজমেন্ট স্পষ্ট থাকে যে আসলে ডিপ্রেসড ব্যক্তি দোয়া পড়ে না। এই আচরণ পেয়ে ঐ মানুষটা আরো বেশি খারাপ ফিল করে, যা তাকে হয়ত (আত্মহত্যার মতন) [২] ভয়াবহ সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

8)”আরেহ, বাদ দাও এইসব ডিপ্রেশন, এগুলা কোনো ব্যাপারই নাহ..” 

– এই কথা বলা খুব ভয়ংকর একটা কাজ। যে মানুষ ডিপ্রেশনে পড়ে নাই, সে ভাবতেও পারে না আরেকজন কেন এই অবস্থায় আছে, তাকে যখন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে বলবেন, তখন সে এতে সংকুচিত হয়ে যাবে, আরো খারাপ ফিল করবে। এটা এক ধরণের অপমান করা। একজন উত্তম মুসলিম হিসেবে এই কাজ আমাদের করা উচিত না।

৫) “তোমার চেয়েও লোকে অনেক খারাপ অবস্থায় আছে …”
– এই ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে খুব প্রচলিত। অনেকেই এসে বলতে থাকে, “দেখো তুমি এটুকুতেই এরকম ডিপ্রেসড, ওই যে দেখো ইয়েমেনের লোকেরা না খেয়ে আছে। ওদের দিকে তাকিয়ে হলেও ভালো থাকো।” — এটা একটা অদ্ভুত ভয়াবহ অন্যায়। ইয়েমেনের শিশুরা খেতে পারছে না, এটা খুবই বড় সত্য। কিন্তু তার মানে তো এটা না যে ডিপ্রেসড মানুষটা কষ্টে ভুগছে না।

নিজেদের কল্যাণের স্বার্থে তাই, এই আচরণগুলো এড়িয়ে চলতে হবে আমাদের। সচেতনভাবে মানুষের সাথে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেকসময় আমাদের অনেকের কেবল প্রয়োজন হয় ভালোবাসা, সহমর্মিতা। কেউ ডিপ্রেশনে থাকলে তার উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে, কিন্তু আমাদের আচরণ যেন তার অবস্থা আরো খারাপ করে না দেয়, সে ব্যাপারে সচেতন থেকে আমাদের নিজ নিজ আখিরাতকে রক্ষা করতে হবে আমাদের। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে উত্তম আখলাক দান করুন, দ্বীনের উত্তম বুঝ দান করুন, আমাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।

রেফারেন্সঃ
[১] সূরা আর-রাদ, আয়াত ২৮ http://tanzil.net/#trans/bn.bengali/13:28
[২] শেইখ আজহার নাসেরের আলোচনা শুনুনঃ https://www.youtube.com/watch?v=MPhYITkCJ_0


Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.