কুর’আনের আলোকে ইফতারের সঠিক সময়

বনী আদম, সংযম, সাশ্রয় এবং ত্যাগের মাস, রমজান সঠিক সিয়াম সাধনায় উত্তীর্ন হতে আল্লাহর আদিষ্ট ও রাসূল পালিত সেহরী ও ইফতারের রোজা পালনে রহমত, মাগফিরাত ও নরকাগ্নি থেকে মুক্তির সাফল্য অর্জন করো। বর্তমান প্রথার উপবাস সর্বস্ব রোজার প্রহসনে গোটা মানব জাতি, বিশেষ করে নামধারী “মুসলমানরা” আল্লাহ কর্তৃক অভিশপ্ত।
সষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব মানবজাতি আল্লাহর প্রতিনিধি রূপে গোটা সৃষ্টির লালনে ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্বে আদিষ্ট। প্রাণী জগতের ক্ষুধা-পিপাসায় আল্লাহ খাদ্য-পানীয় দিয়ে সৃষ্টির লালন পলন করেন। জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ মাহে রমজানে এক মাস নিশা-নিস্কিৃতির সুবহে সাদেক থেকে নিশা আগমনের এশার ওয়াক্ত শুরু পর্যন্ত সিয়াম পালনে আদিষ্ট।
ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালা ভোগ করে স্রষ্টার দানা-পানির মূল্যায়ন ও দীন দুঃখির অভাব-অনটন বিদূরনের কঠোর অনুশীলনের নিমিত্ত¡ মানব সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে সকল প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্যে “উপবাস” পালন বাধ্যতা মূলক ছিলো। মানব সভ্যতার ক্রম বিকাশে পূর্ণতার সূচকে হযরত ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা আঃদের সমাপক শেষ নবী মুহাম্মাদ সঃ প্রেরিত হন। তিনি রমজানের সিয়াম সাধনার চূড়ান্ত রূপদানে আল্লাহ কর্তৃক আদিষ্ট হন। তিনি চূড়ান্ত আদর্শ।
মর্ত্যরে মানুষ স্বর্গরোহন, তথা মেরাজের প্রতিক মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। তাঁর উপর ক্বোরআন নাযিল আরম্ভ হয় এ রমজান মাসে, সত্য প্রতিষ্ঠায় অসত্য নির্মূলে আত্মরক্ষার বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এ রমজান মাসে, পূর্ণ ক্বোরআন চর্চার প্রশিক্ষন কার্যক্রম চালু হয় এ রমজান মাসে এবং সর্বপরি মানুষ বেচা কেনা, মানবতার অবমাননা ও পৈশাচিক গোত্র ও বর্ণবাদী শোষনের হোতা মক্কার ক্বোরেশীদের কব্জা থেকে মান সাম্যের ঐশী মন্দির কা’বা মুক্ত ও পবিত্র হয় এ মাহে রমজানুল মুবারকে।
বিশ্বের অভিন্ন, অবিভক্ত ও একান্ন আদম পরিবার মানবজাতির সেতু বন্ধনের মাস, রমজানে আল্লাহ তাঁর শেষ নবীর মাধ্যমে আমাদের সকলকে আদেশ করেন “তোমরা রাত্র অবধি সিয়ামকে পূর্ণ করবেই। ثُمَّ أَتِمُّ الْصِياَمَ إلَيْلِ (বাক্বারা-১৮৭)
রাসূল সঃ অবশ্যই রাত্র পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করেছেন। “মাগরিব” অর্থাৎ সন্ধ্যা পর্যন্ত করেন নি। তার মৃত্যুর পর সুন্নি খলিফা উমর ও ওসমান রোজা অবস্থায় মাগরিব পড়ে রাতের অন্ধকারের অপেক্ষা করতো। তারপর এশার সালাত আদায় করে তারপরেই ইফতার করতো।
وحَدَّثَنِى عَنْ مَالِكْ، عَنْ إبْن شِهَاب، عَنْ حَمِيْد بِنْ عَبْد الرَحْمَان، أنَّ عُمَر بْن الْخَطَّاب و عُثْمَان بْنَ عَفَّان كَانَا يُصَلِّيَانِ الْمَغْرِبَ، حِيْنَ ينظران إلى الليل الأسود، قبل أن يفطرا. ثم يفطران بعد الصلاة. وذالك في رمضان…
উমর ইব্নুল্ খাত্তাব ও উসমান ইবন আফফান মাগরিবের সালাত পড়তো, তারপর তারা রাতের অন্ধকারের অপেক্ষা করতো, ইফতারের পূর্বে। অতঃপর তারা সালাতের পর ইফতার করতো। এবং অবশ্যই তা রমজান মাসে।
মুয়াত্তা মালিক সুন্নী সম্প্রদায়ের বোখারী ও মুসলিম থেকেও নির্ভর ও প্রাচীনতম হাদিস গ্রন্থ। খলিফা আলীর অনুসারী শিয়া সম্প্রদায় অদ্যবধি আল্লাহর হুকুম ও নবী সঃএর আচরণ অনুযায়ী এশার নামাজ পড়ে তারপর ইফতার করে। (কারো আগ্রহ হলে ঢাকাস্থ ইরানী দূতাবাসে সন্ধ্যার পর গিয়ে দেখে আসতে পারো।
মাগরিব পর্যন্ত রোজা যেরূপ আল ক্বোরআন ও রাসূলের আদর্শে নেই, ঠিক তদরূপ রমজান মাসে রাতের প্রথমার্ধে বিশ রাকাত তারাবীহ্ ক্বোরআন ও রাসূল সঃ এর জীবনীতে কোথাও নেই। বরং রাসূল সঃ রমজানে এশার পর রাতের প্রথমার্ধে কোন নামাজের সংযোজন কঠোর ভাষায় নিষেধ করেছেন। (বোখারী-মুসলিম)
নিছক ব্যক্তিগত খেয়াল-খুশীর উপর খলিফা উমর এ তারাবীর প্রচলন করে তাকে নিজেই “বিদআত” আখ্যায়িত করে নিরুৎসাহিত করেছে।
আমরা মুসলমানরা ঐতিহ্যগতভাবে স্বীকার করি যে রোযা সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্ধারিত এবং মাগরিবের আজান হলেই ইফতারের সময় শুরু হয়। যদিও একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় দৃষ্টি, এই ব্যাপারটি কুরআনের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণরূপে সাংঘর্ষিক। কুরআন সুস্পষ্ট করে বলে যে পানাহার করো যে পর্যন্ত না তোমাদের কাছে ভোরের কালো রেখা সাদা রেখায় প্রকাশ পায়, আর রাত পর্যন্ত সিয়াম পালন করো। (সূরা বাকারা ১৮৭)
শাড়ির যেমন ২ আচল তেমনি দিবসেরও ২ আচল (সূরা হুদ- ১১৪ ‘আক্বিমিস সালাতা তারাফাইন নাহার ওয়া জুলাফাম মিনাল লাইল)। একটি সকাল ও অপরটি সন্ধ্যা। ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন স্পষ্টভাবে, দিন সম্পুর্ন সাদা আর রাত সম্পুর্ন কালো। আর মাঝে দু’প্রান্ত আবছা সাদা। সুর্য উদয়ের যতক্ষন পুর্বে আমরা সাহরী খাওয়া ছেড়ে দেই, সুর্যাস্তের ঠিক ততক্ষন পরে আমরা ইফতার করিনা। তার আগেই রোজা ভেঙে ফেলি!! (ছবিটে ক্লিয়ার বুঝা যাবে)
ইফতারের সময় সম্পর্কে যাতে উম্মাহর মধ্যে কোনো সন্দেহ বা দ্বিধাবিভক্তির সৃষ্টি না হয়, এর সব প্রমাণ, নির্দেশ, দলিল ও ব্যাখ্যা কোরআনে বিদ্যমান। আল্লাহ দিবা-রাত্রি এবং মধ্যবর্তী বিভিন্ন সময় উল্লেখ করতে ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘লাইল’ অর্থ রাত, তা কোরআনে ১৬২টি স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে; কোরআনে ব্যবহৃত ‘লাইল’ শব্দ দ্বারা কখনো, কোনোভাবেই সন্ধ্যাকে বা সূর্যাস্তের সময়কে বোঝায় না। তদ্রূপ সবাইকে ‘বুকরা’, অপরাহ্নকে ‘নাহার’ বলা হয়েছে। কোরআনে বিকেলের সময় সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা ‘সুরা আল আসর’ বিদ্যমান। সন্ধ্যা সম্পর্কে ‘আসওয়াল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (১৩:১৫)। প্রভাতকাল সম্পর্কে সুরা মুদাচ্ছিরের ৩৪ নম্বর আয়াতে ‘সুব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সূর্যাস্তের সময়কে কোরআনে সুরা তাহা ১৩০, কাহাফ ৮৬ এবং ক্বাফ-এর ৩৯ নম্বর আয়াতে ‘গুরুবে শামস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সূর্যাস্তের পর পশ্চিম আকাশে রক্তিম আভার সৃষ্টি হয়, যা ১ ঘন্টা ১২ মিনিট পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে, সে সময়কে সুরা ইনশিক্বাকের ১৬ নম্বর আয়াতে ‘শাফাক্ব’ শব্দে উল্লেখ করা হয়েছে এবং শাফাক্বের পূর্ণ সমাপ্তির পরই যে ‘লাইল’ বা রাত শুরু হয় তাও সুরা ইনশিক্বাকের ১৬ ও ১৭ নম্বর আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। উল্লেখিত সব আয়াত দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, ‘লাইল’ বা রাত হলো এমন একটি সময় যা পরিপূর্ণভাবে বা সম্পূর্ণভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন। যেখানে দিনের আলোর উপস্থিতির কোনো প্রশ্নই আসতে পারে না। ‘লাইল’ অর্থ রাত, শাফাক্ব, গুরুবে শামস, আসর বা আসিল নয়। কোরআনে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ আছে, ‘রাতে তোমরা সিয়াম পূর্ণ করো।’
হাদিস শরিফ থেকেও আমরা প্রমাণ পাই, আল্লাহর রাসুল (সা.), সাহাবায়ে কেরামরা কখনো গুরুবে শামস বা সন্ধ্যার সময় ইফতার করেননি। সম্পূর্ণ অন্ধকারাচ্ছন্ন তথা রাত শুরু হওয়ার পরই তাঁরা ইফতার করতেন। ইমাম মালেকের মুয়াত্তার প্রথম খণ্ডের ২৩৯ পৃষ্ঠার ৬৯৪ নম্বর হাদিসে উল্লেখ আছে, ‘হুমায়দ ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, উমর বিন খাত্তাব (রা.) ও উসমান বিন আফফান (রা.) উভয়ে মাগরিবের নামাজ পড়তেন এমন সময়- রাতের অন্ধকার ছেয়ে যেত আর এটি ইফতারের আগে। অতঃপর তাঁরা উভয়ে ইফতার করতেন। এ শিক্ষা তাঁরা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকে পেয়েছেন।’
বোখারি ও মুসলিম হাদিস গ্রন্থে হজরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘সূর্যাস্তের পর যখন পূর্ব দিক থেকে অন্ধকার হয়ে আসে এবং দিনের আলো পশ্চিম দিক থেকে সম্পূর্ণ চলে যায়, তখন রোজাদারদের জন্য ইফতারের সময়।’ (আরো দেখুন তাফসিরে ইবনে কাসির, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৯৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ)।
হজরত ইবনে সা-দ সায়েদী থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যত দিন মানুষ জলদি ইফতার করবে, তত দিন তারা কল্যাণপ্রাপ্ত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
সত্বর ইফতার করার মানে এই নয়, ইফতারের সময় হওয়ার আগেই ইফতার করে ফেলতে হবে! রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই হাদিস দ্বারা এটাই বোঝানো হয়েছে, ইফতারের সময় হলে বিলম্ব না করে যেন ইফতার করে ফেলা হয়।
** ইফতারের সঠিক সময় মাগরিবের ওয়াক্তের ১ ঘন্টা ১২ মিনিট পর।
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ
“ আমি গোটা মানব জাতির পথ নির্দেশরুপে র্দ্ব্যথহীন ভাবে যা’ আল কোরআনে নাযিল করেছি, তাকে যারাই গোপন করে , তাদের সকলকে আমি আল্লাহ স্বয়ং এবং আমার সাথে আমার সৃষ্ট সকল অভসিম্পাতকারী অবশ্যই অভিসম্পাত করে ।” (বাক্বারা-১৫৯)
و قل جاء الحق و زهق الباطل إن الباطل كان زهوقا
এবং চূড়ান্ত ঘোষনা দাও” একক মহাসত্যের আগমনে সকল অসত্যের মূল উৎপাটিত হচ্ছে, অবশ্যই সত্যের উত্থানে অসত্যের নির্মূল বিধিত। (বনী ইসরাঈল – ৮১)
25-05-2017

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.