দার্জিলিং এ টাইগার হিলে শীতের কোন এক রাত। তাপমাত্রা -১/-২ ডিগ্রী। ১০,০০০ ফুট উপরে পাহাড়ে বিদ্যুৎ নেই। পুরো পাহাড়টায় তখন অদ্ভুত এক নিরবতা আর আঁধার নেমে আসে। বাতাসের গর্জন আর পাতার পড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায়না। চাঁদের আলো ছাড়া আর কোন আলো নেই। তেমনই এক মধ্যরাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার। গুমোট আঁধার ভেদ করে ভেসে আসছে ঠান্ডা বাতাশের গর্জন। সাথে পাহাড়ের সেই বাতাসের সাঁই সাঁই শব্দ। টর্চ লাইটের আলোতে তাঁবুর ভেতরে আধশোয়া হয়ে শুয়ে শুয়ে বউ এর কথা ভাবতেছিলাম। প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছিলাম। এই সময়েও ভাবুক ভারতীয় বন্ধু জনি প্রামানিক আর সূর্য্য দা তখন কাঠে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত। হঠাৎ ডাক দিল ওদের কাছে যেতে। চোখ কচলে উঠে গেলাম। তাঁবুর বাইরে কিছুই দেখা যায়না আঁধারের কারণে। মোবাইলের টর্চ লাইট জ্বেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঠান্ডা লাগছিলো। জ্যাকেটটা চেন লাগিয়ে এলাম। জনিকে দেখা যাচ্ছিল না। একটা আকৃতি দেখেই বুঝে নিলাম সে জনি। – কি হইসে?– উপরে দ্যাখ
বুকটা ধক করে উঠলো। আমার মাথার ওপর যেন সমস্ত আকাশ। যেন এই কোনা থেকে ঐ কোনা দেখা যাচ্ছে। একটা চাদরখুলে ধরলে যেভাবে তার পুরোটা দেখা যায়। একদম তেমন। একেবারে নিকষ কালো একটা আকাশ। আর সেই অন্ধকার আকাশের বুক চিরে জ্বলে আছে লক্ষ লক্ষ অজস্র তারা। একদম লেড বাতির ল্যাম্পের মত। অসংখ্য বিন্দু বিন্দু তারা জ্বলে আছে সমস্ত আকাশে। কখন ভাবতেও পারিনি একসাথে এত তারা দেখা সম্ভব। ইট কাঠের শহরের রাতের আকাশে যে তারা দেখতাম, তা হয়তো কষ্ট করে ধৈর্য ধরলে গুনেও ফেলা যায়। কিন্তু আমার মাথার ওপর এখন যা দেখছি, তা সত্যিকার অর্থেই অসংখ্য। একেবারে গাণিতিক ভাষাতেই অসংখ্য। আমি কখনও ঘটা করে খোলা আকাশে তারা দেখিনি। আমার কাছে তা আঁতলামি মনে হত। ভাবালুতা মনে হত। সেদিনই প্রথম দু চোখ মেলে দেখেছিলাম। দু চোখ ভরে দেখেছিলাম। চোখ ফেরাতে পারিনি।সেদিন ভেতরে একটা অনুভূতির জন্ম নেয়। হিম হিম ঠান্ডার নিশ্চুপ সে রাতে বিশাল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমি নিজের অবস্থান কল্পনা করার চেষ্টা করি। বৃথা চেষ্টা ছিল। আমার মাথার ওপর যা দেখা যাচ্ছিল, তার তুলনায় আমার প্রকৃতপক্ষে কোন অবস্থানই ছিলনা।এরপর থেকে আমি আর আকাশ দেখার সাহস পাইনা। নিজের ক্ষুদ্রতার কথা মনে পড়ে। নিজের অবস্থানহীনতার কথা মনে পড়ে। নিজের মিছে অহংকার আর অহমিকার কথা মনে পড়ে। আমরা মানুষরা আসলে অহংকারপ্রিয়। গৌরবপ্রিয়। পান থেক চুন খসতে না খসতেই আমরা গর্বিত হই। পরীক্ষা পাশে গর্ব। ভালো জায়গায় চান্স পেয়ে গর্ব। সন্তানের কাজে গর্ব। পুরস্কারে গর্ব। সৌন্দর্যে গর্ব। বংশের গর্ব। সমাজের গর্ব। দেশের গর্ব। জনপ্রিয়তায় গর্ব। ভাষার গর্ব। নিজের ব্যক্তিত্বে গর্ব। মেধায় গর্ব। বিত্তে গর্ব। এটায় গর্ব, ওটায় গর্ব। এখানে গর্ব, ওখানে গর্ব। গর্বের শেষ নেই। সমস্ত সৃষ্টিজগতের দিকে যদি আমার একটু অন্যভাবে নজর দিই, তাহলে অবাকই হতে হয়। আমরা প্রতিদিন মেঘ দেখি, বিশাল আকাশ দেখি, দেখি সুবিশাল মহাসাগর, সাগর তলের অবিরাম বৈচিত্রময় জগৎ দেখি, আকাশের বাইরের জগৎ দেখি, দেখি মহাবিশ্বের গ্রহাণুপুঞ্জের চিত্র, অন্তহীন মরুভুমি, আকাশছোঁয়া পর্বত, দেখি লক্ষ নক্ষত্রের চিত্র।
কিন্তু কখনই এসবের ব্যপকতা বা বিশালতা আমাদের নাড়া দেয়না। আমাদের ভেতরটায় এতটুকু ধাক্কা দেয়না। আমাদের এতটুকু ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেনা, যিনি এইসব সৃষ্টি করেছেন, তিনি কত ব্যাপক। তিনি কতটা বিশাল। কতটা অসীম।
আমরা কখনই চাইনা সেই বিশাল, ব্যাপক, অসীম স্বত্ত্বা সম্পর্কে ভাবতে। কখনই চাইনা নিজের ক্ষুদ্রতা নিয়ে ভাবতে। নিজের মিথ্যে গর্ব আর অহংকার নিয়ে লজ্জিত হতে। আমরা কখনই নিজেদের ক্ষমতা আর যোগ্যতা নিয়ে ভাবিনা। যে সুবিশাল পৃথিবী আমাদের এর স্রষ্টাকে নিয়ে ভাবতে শেখানোর কথা, সেই পৃথিবীর পাতা জালেই আজ আঁটকে গেছি আমরা। সেই ব্যাপক অসীম স্রষ্টার দেয়া জ্ঞানে আবিষ্কৃত হয়েছে জ্ঞান বিজ্ঞানের জগৎ, কথা ছিল সেই জ্ঞান বিজ্ঞানই খুলে দেবে অসীম সেই স্বত্বাকে খুঁজে বেড়ানোর দুয়ার। কিন্তু সেই জ্ঞান বিজ্ঞানকেই আমরা ব্যাবহার করছি তাকে ভুলে থাকতে, তাকে অস্বীকার করতে। প্রকৃতির যেই অসম্ভব বিশালতা আর ব্যাপকতায় আমাদের স্রষ্টার কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়ার কারণ খুঁজে পাওয়ার কথা, সেই প্রকৃতিকেই আমরা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি সেই সত্ত্বার বিরুদ্ধে।কত ক্ষুদ্র আমরা। কত নগণ্য। কত ছোট্ট। কত নিকৃষ্ট।
কেউ যখন গর্বিত হয়, অহংকারী হয়, আমার কেন জানি মনে হয় টাইগার হিলের সেই আকাশের তারাগুলো মিটমিটিয়ে হাসে। আমাদের মত অবস্থানহীন কিছু প্রাণী যখন গর্বিত হয়, অহংকারী হয়, তখন তারাগুলো হাসে। ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশের মেলে ধরা চাদরের মাঝে জ্বলে থাকা অজস্র লেড বাতির মত তারাগুলো।
০১/০১/২০২০
টাইগার হিল, দার্জিলিং, ভারত।