পাঁচ কবিতা – ত্বোয়াহা বিন হাবিব

লা ইলাহার তসবীহদানা

– কবির নবী

বিরাম পুরের যাত্রী, এ তো মাত্র রাত শেষে

ভোর হয়ে দিন শুরু! যাত্রা শুরু!

সাত তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে বিরাম পেতে

বিরামপুরে যাবে? এ কেমন তরো!?

এ কেমনতরো সত্য বলা! সত্য পথের

সত্যালাপের কাব্য গুরু?

না, আরো কিছু দিন, কিয়ৎ কাল,

আদম হাওয়ার বেটা বেটিদের সম্বিত্

দিতে কবিকে বঙ্গের বটমূলে কবিতা

বলে, ফিরতি পথ দেখাতে হবে। যাদের ভুল

শুড়শুড়ি দিয়ে রমণীরম্ভার পেছনে লেলাতে

কবি স্বপ্নপুরি এঁকেছে। নিজেও কাতু কুতু খেয়ে,

দিয়ে, ঢলাঢলি, গলাগলি কম করেনি।

তবে ওদের না সামলে-বেসামাল ছেড়ে

বিরাম পুরে যাত্রা-না পালায়ন?!

সত্যের যাত্রা বিরতি, বিরাম নেই। সত্য

বিরামহীন যাত্রার, যাত্রির মহা সড়ক।

নবী কবি, কবি নবী, কাব্যগাঁথা, নকশি কাঁথা,

রং বেরঙ্গের সুঁই সুতা। আদম হাওয়ার দিন

দুনিয়া, পুরুষ নারীর ক্ষেত খামারী, বাপের বাড়ি

স্বামীর বাড়ির,বাসর ঘরে বাঁশির সূরে, একাল

সেকাল মালা গেঁথে, গলে গলে বদল করে, তবেই

গেলে বিরামপুরে আরাম পাবে।

নর-নারীর নরক গড়ে, ফেলে গেলে, ছেলে পেলে,

বাড়ি গাড়ি দালান কোঠা, পেরেত পুরীর

পাপের মেলা, কবর হাশর নারের জ্বালা।

নার নেভাতে, নূরের নদী, হুরের পাখার হিমেল

বাতাস, পাড়ি দিতে সপ্ত আকাশ, চুলচেরা সব

হিসাব নিকাশ, যেই কিতাবে হলো প্রকাশ,

জিব্রাঈলের ডানার বোরাক, এক উড়ানে ক্বোরান

পুরান, তিরিশ পারার সবক শেখান।

মুহাম্মদী রিসালাতের, নূহ নবীর শরীআতের, মূসা

ঈসার মারিফাতের, আসা অসির মোজেযাতে,

ইরান, ইরাক, হিজায থেকে, সুন্নী-শিয়া যায়নবাদের

প্রজ্জ্বলিত আগ নেভাতে, লাল সবুজের আলপনাতে, আল

ক্বোরানের স্রোতধারায়, দাজলা ফোরাত একি সাথে, একি মতে,

প্রবাহমান একি স্রোতে।

রোজ হাশরের আমলনামা, দীন দুনিয়ার সফর নামা,

আমারি এ কিতাব খানা, লা ইলাহার তসবি দানা।

বিরামপুরের যাত্রী

-আল মাহমুদ

১.

সমাপ্তির কাছে এসে মন বলে, একটু বিশ্রাম

একটু বিরাম হোক এই ভেবে বসে পড়ি মায়ার পাহাড়ে

আরাম মানেই- নিদ্রা, স্বপ্ন বলে কি তোমার নাম

কি তোমার তবে?

২.

আমার নাম কবি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি বিরামপুরের যাত্রী

পার হয়ে এসেছি কতো গ্রাম, এই রামনগর অবধি

কত নদী কত গৃহস্থালী। জেনেছি নারীকে আগে, এইবার

মাটির স্বাদ চাই। এই মাটি ঘামে ভেজা রক্ত সিক্ত কর্দম মাত্র নয়।

এই মাটি পুরুষের বুক। এই মাটিকে কে বলে মৃত্তিকা?

কত দরবেশ ঘুরাতে ঘুরাতে তারার তসবিহ দানা পার হয়ে চলে গেছে

পাথরের লৌহকপাট। তারা ছিলেন বিরামপুরের যাত্রী

এখন আমিও।

৩.

বলেছি তো নারীর স্মৃতি শেষ। নারী বড় অনাহারি, সাততাড়াতাড়ি

চোখের আগুনে ভস্ম করে ঘর-বাড়ি। লাকড়ির মতো পোড়ায় পুরুষ সত্তা

পৃথিবীকে করে দৃষ্টিহীন কিন্তু আমি যেখানে যাব সেই বিরামপুরে

আমি জানি আছে সাদা মেঘের সম্ভার। আছে বৃষ্টি

আছে সৃষ্টি, আছে কৃষ্টির বিলাস। সর্বোপরি আছে তো বিরাম।

এই মাটি পুরুষের বুক।

নারীর গর্ভ ছিঁড়ে ছুটে আসা লক্ষ লক্ষ শিশুর চিৎকার। এই মাটি।

পুরুষের রক্তে ভেজা আঁঠালো কাদার এই রং যেন জংধরা

তামার বাসন কিংবা যেন মাছের কংকালে গড়া কাল মাটি

কার যে কবরের জন্য উন্মুক্ত। কিংবা বিশ্রাম। এই মাটি।

আমি তো দেখেছি কত রমণীরম্ভার সাদা বুক।

দেখেছি পিঠের হাড়, দেখেছি নিতম্বের গুরুভারে কাঁপছে পৃথিবী

কিন্তু জানি মাটি হল চিরকাল পুরুষেরই বুক। যেন বা

গ্রানাইট পাথরের গুঞ্জরিত কবিতার অক্ষর। এই মাটি।

আমি বিরামপুরের যাত্রী উত্তরের পূব পূবের উত্তর, যেখানে

মায়ার পাহাড় আছে, আছে কাঞ্চনমালার সেই পাথরের আশ্চর্য চাতাল

আসলে তো পুরুষেরই বুক। এই মাটি!

১২.১২.২০০৩

বিড়াল-শূণ্য বারান্দা

-শামসুর রাহমান

আমি কি এভাবে নিজেকেই কুরে কুরে খেয়ে ফেলে

বাহবা কুড়িয়ে যাবো দশদিকে? দ্যাখো,

এই ক্ষয়া আমাকে খুঁটিয়ে দ্যাখো। না, না,

অমন কষ্টের ভার স’য়ে যাওয়া আমার নিয়তি সুনিশ্চিত।

আসবে কি তোমরা আমার আস্তানায়? না, তেমন

বিড়ম্বনা হবেনা পোয়াতে। দেখে যাও,

এখানে তেমন ভিড় নেই আসবাবপত্রের, কেবল কিছু

পছন্দের বইপত্র আছে। মাঝে মাঝে

চাইলে অথবা না চাইলে

কিয়দ্দূর থেকে ভেসে আসে বাঁশির মধুর সুর।

আমার বিনীত বারান্দায় প্রায়ঃশই একটি বিড়াল এসে

বসে থাকে খাদ্যের আশায়। আমি ওকে

হামেশা আমার পাত্র থেকে মাছ, মাংস

কিংবা অন্য কোনও খাদ্য দিই ভালোবেসে।

বেশ কিছুদিন পর লক্ষ্য করি, সেই

অতিথি আমার মানে বিড়ালটি আসে না আর; প্রশ্ন জাগে-

কোথায় হারিয়ে গেলো কোন্ ঝোপঝাড়ে? সে কি তবে

হয়েছে শিকার দ্রুত ধাবমান কোনও মোটর কারের?

জানতে পারিনি আজও কে বাজায় বাঁশি। সে কি সুখী?

নাকি কোনও গুপ্ত বেদনার ছায়া তাকে

রয়েছে দখল করে বহুদিন থেকে। ব্যক্তিগত

দুঃখের আঁচড় আমি যতদূর পারি

আড়ালেই রাখি। তবু বারান্দায় সেই বিড়ালের

খাঁ খাঁ অনুপস্থিতির ছায়া শুন্যতাকে আরও গাঢ় ক’রে তোলে।

বেশ কিছুকাল পর ভুলে যাই চেনা বিড়ালের উপস্থিতি-

চেয়ারে হেলান দিয়ে বই পড়ি, কখনও টেবিলে

ঝুঁকে কোনও অসমাপ্ত কবিতা শেষ পঙ্ক্তিমালা

রচনায় ফের দরবেশ তুল্য ধ্যানী হয়ে যাই।

১১.১২.২০০৩

১.গদ্য পদ্য: কবি ও মোল্লা

তোরা যতো সব কবি,

দেখিস্ কখোনো, আয়নায় তোদের চেহারা ছবি,

বিচ্ছিরি? দেখসনা, দেখিসনি, দেখবিনা,

কারণ, তোরা তো জানিস সবি,

তোরা তো তোদেরই অন্তর্যামী!

লুকাস্ রেশমী পর্দায় তোদের শ্রী, বিচ্ছিরি,

ওযে রেশমী পর্দা নয়, ওযে বেশ্যার আঁচল!

লুকাবি কোথা! যুগ যে প্রকাশের! ন্যাংটার! বিশ্ব ন্যাংটা।

ওর নাকি বিশ্বায়ণ হচ্ছে? তাই বেশ!

দেখো, অই বইমেলা! না বৌমেলা!

সব খোলামেলা, বটতলা, বকুলতলা,

আমতলা, যেনো কদম্বতলা। “তোরা সব বৌখেলা ”।

কারো ঘর নেই, বাসেরও না, বাসরও না।

যেনো নেই ঘরে, ভাত-ভাতার। তাই, বাসর ওদের হাট বাজার!

কি মজার!

আঁকছি আমি তোদের ছবি, যেনো আমি তোদের নবী।

তোদের, কাকেও খেলো প্রমিলায়,

মুখে কারো পেচ্ছাব করলো তসলিমায়,

কাকেও গিললো হাড়গিলায়।

অসভ্য সব সব্যসাচী, আসলে যে,

তোরা সবাই- লুচ্চা পাজি।

নেই বিয়াতে মোল্লা কাজী,

মিঞা বিবি উভয় রাজী,

“ক্যায়া কারেগা, ফকির কাজী?”

মোল্লা কাজীর টংকাবাজী,

টংকা পেতেই ধান্দাবাজী, ধাপ্পাবাজী,

হারাম হালাল, হালাল হারাম, ,সবেই আরাম,

আযীযুল হক, গোলাম আযম, একি ধাতের বনী আদম।

গদীর লোভে, কড়ি লাভে, পাগড়ী দাড়ী একি লাফে,

হেজাব কিতাব লাত্থি মেরে, ঢুকে পড়ে চুলের খোঁপে।

শীষ মহল আর তাজ মহলে, মোল্লারাও ভোঁদড় নাচে,

দিন দুনিয়া নরক করে, পানির দামে ক্বোরান বেচে।

২.পদ্য গদ্য: নষ্ট ভ্রষ্টের হালখাতা

এবার লিখি, নষ্ট ভ্রষ্টার নরক রাজ্য নিয়ে,

লৌহ কলমের বজ্রপ্রকাশ; নয় ইনিয়ে বিনিয়ে।

আদম হাওয়ার স্বর্গে ঢুকেছে ইবলীস; স্বর্গ নরক একাকার,

মানুষ শয়তান, ভাই ভাই; শান্তি নেই, শান্তি চাই, হাহাকার।

দোষ কার? নর, না, নারীর? শেলাই সূঁচের পাছা মাথা, তাতেই,

আদম হাওয়ার জীবণ গাঁথা; রঙ বেরঙ্গের  নক্শি কাঁথা।

সূঁচের পাছায় সূতো গেঁথে, গাঁথো যতো ফুলের মালা।

সুঁইয়ের মাথা আগে চলে, পাছা সূতা পিছে পিছে, বিঁধে

বিঁধে কাপড় বোনে, শরম ঢাকে, আব্রু ঢাকে,

স্বর্গ গড়ে ধরার বুকে।

একি!? ইবলীসেরি এক পলকে, উল্টে দিলে সুঁইটাকে!?

উল্টো ঠেলে সুঁই- সূতা, লাগলে খেতে সুঁইয়ের গুতা!

তাই, হাতে ব্যাথা, বুকে ব্যাথা, সারা অঙ্গে ব্যাথার ব্যাথা।

তারপর?

সূধার বধূ ভেঙ্গে সুঁই, এক সদনে হইলো দুই!

ভাঙ্গা সুঁইয়ের ঠেলাঠেলি, কিলাকিলি নিত্য বিবাদ,

বিরাম নেই।

হাঁসা-হাঁসি ভেঙ্গে ঘর, বর কনেতে হলো পর,

রেন্টু  শৃগাল, হিঁদু মৃনাল, হাঁসা হাঁসির মাঝখানে,

নষ্ট পিড়ির হলো বর।

তুমি না গো শেখের ঝি?! জানলে লোকে বলবে কি?

“শুনিসনেরে  লালন শাঁই! নারী জাতির খতনা নাই?

তাই যে নারীর ধর্ম নাই!? বলছে বাবা ‘ব›দ্ধু-ভাই’ যখন যেমন, তখন তেমন,

ইয়া হোসেন, ইয়া হোসেন।

শিঁথে দিলাম শঙ্খ সিঁদুর, হিঁদু হলে কি আসে যায়?

তুমি এখন কামাল হোসেন।

রেঁধে খেয়ে গরুর  বট্, ভাঙ্গরে রেন্টু মঁদির মঠ,

পুলিশ- সেনার লাশ চাই, নেরে  টাকা যতো চাই।

লাশে গড়া, লাশে শেষ, “ভাঙ্গা বন্ধুর ভাঙ্গা দেশ”,

বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।

রেন্টু খেপে হাঁক ছাড়ে, ভাঙ্গে হাড়ি সোচ্চারে-

“এসব কিছুর বিচার চাই, নইলে আমার ফাঁসি চাই”।

পুতুল খালার হালও তাই, আছেন খালু ফালু ভাই।

বল্ বাঙ্গালী কোথায় যাই?

মোল্লার ঘরে আল্লাহ নাই, আল্লাহ্র ঘরে মোল্লা নাই।

গীর্জা কা’বা, সব ফাঁকা, শুধু খাঁ-খাঁ।

শামসু কবি মামুদ কবি, দরবেশী ধ্যাণ, বিরামপুরী,

তস্বি দানা, ভন্ড গোনা, কাজ হবেনা; ফল হবেনা।

আসছে মউত দোরের গোড়ে, নিতে কেড়ে জীবণ আয়ূ, প্রাণের বায়ূ।

আঁকলে দিলে খোদার ছবি, যেমনি ছিলেন খোদার নবী।

তানা হলে রক্ষা নাই- বলছি আমি কবির নবী,

মরণ স্মরণ কাব্য যাদের, তারাই সেরা, তারাই কবি

মৃত্যুঞ্জয়ী।


Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.